দুর্নীতিগ্রস্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত খুলনার ‘গডফাদার’, শেখ মুজিবের ভাতিজা এবং সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তার বিরুদ্ধে নানা সময় ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাৎ এবং রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তাদের নমিনেশন পাইয়ে দেননি।
তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধিরও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ঈদের সময় নিজের নামে দান করার জন্য সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে এক/দুই লাখ টাকা জাকাত সামগ্রীও নিতেন।
সরকার পতনের পর শেখ হেলাল উদ্দিন দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। জানা গেছে, ছেলে শেখ সারহান নাসের তন্ময়ের সঙ্গে কলকাতায় পালিয়ে গেছেন শেখ হেলাল। পালানোর সময় সীমান্তে শেখ তন্ময়ের প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল। বর্তমানে ছেলের সঙ্গেই তিনি কলকাতায় থাকছেন।
তবে শেখ হেলালের স্ত্রী শেখ রূপা ঢাকায় তাদের মেয়ে শেখ শাইরার বাসায় রয়েছেন। শাইরা বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ’র স্ত্রী। তার মা শেখ রেবা রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের ভাইঝি। সেই হিসেবে শ্বশুর সম্পর্ক ছাড়াও শেখ হেলাল পার্থর মামা।
এদিকে, শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর পর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করছেন ফোনালাপ এবং বিবৃতির মাধ্যমে। রোববার (১৯ জানুয়ারি) দলের দেশে এবং বাইরে অবস্থানরত সব স্তরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে জানান দলের নেতা-কর্মীরা। এই বৈঠকের উদ্দেশ্য দলকে সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় করা। কিন্তু শেখ হেলাল কলকাতায় অবস্থান করলেও আজ শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল সভায় যোগ দেননি বলে সূত্রে জানা গেছে।
এর আগে ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) শেখ হেলাল উদ্দিন, তার স্ত্রী রুপা চৌধুরী, ছেলে শেখ সারহান নাসের তন্ময় এবং তাদের পরিবারের সকল ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেন স্থগিত করে।
শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে অন্যতম হলো দলীয় মনোনয়ন পেতে প্রার্থীদের মোটা অঙ্কের অর্থ দিতে বাধ্য করা। দক্ষিণবঙ্গের প্রার্থীদের জন্য ছিল একটি অলিখিত নিয়ম, যার ফলে মনোনয়ন পেতে হলে একটি শুল্কমুক্ত বিলাসবহুল গাড়ি উপহার দিতে হতো, যা সংসদ সদস্যরা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আমদানি করতে পারতেন। নির্বাচিত হওয়ার পর এসব গাড়ি শেষ পর্যন্ত শেখ হেলালের কাছে পৌঁছে যেত। এছাড়া, দক্ষিণাঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির পুরো নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে, যেখানে চাকরি, বদলি, ঠিকাদারি, ব্যবসায়ীদের ব্যাংক থেকে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার কমিশন সবই চলত তার ইশারায়। এভাবে শেখ হেলাল কয়েকটি জেলায় নিজের নামে এবং বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
বাগেরহাট-১ আসন থেকে শেখ হেলাল ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৯, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই পুরো সময়জুড়ে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, সেইসঙ্গে বরিশাল অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। বিশেষ করে সংসদ সদস্য মনোনয়ন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দিতেন তিনি।
বরিশাল অঞ্চলের কয়েক জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে দেওয়াও ছিল শেখ হেলালের ব্যবসায়িক পরিকল্পনার অংশ। তাদের ঠিকাদারি থেকে হেলাল ও তার ছেলে কমিশন নিতেন। কমিশন বাণিজ্যের সেই সূত্র ধরেই প্রশাসন দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতিয়ে এনে স্মাগলিং রুট নিজেদের কবজায় রাখেন শেখ হেলাল।
শেখ হেলালের ছত্রছায়ায় থাকা এইসব ব্যক্তি দক্ষিণ জনপদের এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। তাদের ইশারায় চলে সেই অঞ্চলের সব অপকর্ম। তারা নৌপথে মাদক এনে দক্ষিণ অঞ্চলে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন। এরমধ্যে ইয়াবা ও অস্ত্র চোরাচালান অন্যতম। এছাড়াও তারা নৌপথে কয়লা, বালু, সাপের বিষ, সোনা, চোরাচালান অপরাধে জড়িত।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ পরিবারের দুর্নীতির জাল কতদূর বিস্তৃত, তা নিয়ে এখন নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান আরও জোরদার হলে দক্ষিণাঞ্চলের ‘মহারাজ’ শেখ হেলালের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।- সূত্র : ইত্তেফাক